এই আর্টিকেলটি পোষা পাখি
সম্পর্কে নয় বরং পোষা পাখি বা খাচায় পালন করা পাখিদের যে খাবার দেওয়া হয় সেগুলোর ব্যাপারে।
এই লিখায় আমরা জানার চেস্টা করব সেই ফসল গুলো নিয়ে যেগুলো আমরা আমাদের প্রিয় পাখিটিকে
রেগুলার খাওয়াই। এই ফসল গুলো দেখতে কেমন ? এগুলোর গাছ গুলো কেমন হয় ? এই ফসল গুলোর
পুষ্টি গুণ কেমন ? এগুলো কি শুধুই পাখিদেরই খাবার নাকি মানুষ ও খাবার হিসেবে গ্রহণ
করতে পারে ? দেশের কোন অঞ্চলে কোন ফসল গুলো পাওয়া যায় ? ইত্যাদি সব বিষয় গুলো দিয়ে
সাজানো হয়েছে এই আর্টিকেল।
কাউন
কাউন, Photo: তোতা মিয়া এগ্রো |
ইংরেজি নামঃ Foxtail millet
বৈজ্ঞানিক নামঃ Setaria italica
আঞ্চলিক নামঃ কাউনের অন্য বাংলা নামগুলো হচ্ছে কাঙ্গুই / কাঙ্গু, কোরা, কান্তি, দানা, শ্যামধাত, শামাধান, শামা চাল ইত্যাদি
পাখির খাবারের মধ্যে প্রথমেই আমরা জানব কাউন বা কাওন এর ব্যাপারে। এটি পাখির খাবার হিসেবে খুবই কমন একটি শস্যদানা। কাউন চাল ছিলো গরীবের খাবার। ছোট দানা বিশিষ্ট শস্যটির দাম এখন গরীবদের হাতের নাগালের বাইরে। কাউন এখন বিলাশী চাল। চাল বা গমের মতো এই দানায় শর্করা নেই। পুষ্টিবিদরা কাউন চালকে সুপারফুড হিসেবে পরামর্শ দেন। যার জন্য স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ খুব সহজেই কাউন চালকে বেছে নেন।
বাংলাদেশের কোন কোন অঞ্চলে এটি মিশ্র ফসল হিসাবে গ্রীষ্মকালে উৎপাদিত হয়ে থাকে। এটি ধানের বিকল্প হিসাবে আমদের দেশে সিলেট, পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং উত্তর বঙ্গের জেলা সমূহে ব্যাপকভাবে কাউনের চাষ করা হয়। কাউন প্রায় সব ধরনের মাটিতেই চাষ করা যায়, তবে বেলে দো-আঁশ মাটিতেই এই ফসলের ফলন বেশি হয়।
কাউন গাছ, Photo: wikipedia.org |
আমদের
দেশের আবহাওয়া ও জলবায়ু কাউন চাষের উপযোগি বিধায় দেশে বিভিন্ন জাতের কাউনের চাষ
করা হয়। তিতাস, বারি কাউন-২ ও বারি কাউন-৩। বেশি ফসল পাওয়া যায় দেখে ১৯৮৯ সাল থেকে
তিতাস জাতটিই বেশি আবাদ করা হয়ে আসছে।
কাউন চাল হতে প্রস্তুত খাদ্য
কাউনের চালের পায়েস এবং
জাউ খুবই মজাদার এবং দেশের বিখ্যাত দুটি খাবার। কাউন চাল দিয়ে শুধু পায়েশ এবং জাউ নয়
এমনকি কাউনের চাল দিয়ে ক্ষির বিরিয়ানি, ভুনা খিচুরি এমনকি সাদা ভাতও রান্না করা যায়
।
আর কাউনের সবচেয়ে বেশি
ব্যবহার হয় বেকারিগুলোতে। কাউনের আটা ময়দা সুগন্ধি, তাই কাউনের আটা ময়দা কেক এবং বিস্কুট
তৈরীতেও ব্যবহার করা যায়।
চাল বা গমের মত এই দানায়
শর্করা নাই , যার জন্য স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ সহজেই কাউন চাল কে বেছে নেন।
কাউন চালের উপকারিতা
- ছোট দানাবিশিষ্ট কাউনের চালে আছে প্রোটিন, ফাইবার, অ্যান্টি-অক্সিডেন্টসহ আরো অনেক পুষ্টি উপাদান।
- যেকোনো দানাদার খাদ্য উপাদানের চাইতে কাউনের চালে আঁশ অনেক বেশি থাকে। তাই কাউনের চালের যেকোনো খাবার বানিয়ে খেলে পাকস্থলী ভালো থাকে।
- পর্যাপ্ত পরিমাণ ম্যাগনেসিয়াম, পটাশিয়াম, জিংক ও আয়রন থাকায় কাউনের চাল নারীদের জন্য বিশেষ উপকারী খাদ্য।
- কাউনের চালে থাকা কিছু উপকারী উপাদান আমাদের রক্তে মিশে থাকা এলডিএল বা খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে।
- কাউনের চালে থাকা পটাশিয়াম আমাদের শরীরে লবণের ভারসাম্য বজায় রেখে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে।
- কাউনের চালে পর্যাপ্ত পরিমাণ আঁশ থাকায় কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে।
- এতে ভিটামিন সি রয়েছে। তাই নানা উপকারি খনিজ উপাদান দেহ গঠনে সাহায্য করে।
- আঁশযুক্ত খাবার খেলে পেট অনেক লম্বা সময় পর্যন্ত ভরা থাকে। ফলে ঘনঘন ক্ষুধাভাব দেখা দেয় না। এতে সহজেই ওজন কমানো সম্ভব হয়।
মিলেট
মিলেট কোন নির্দিষ্ট
ফসল নয়। জোয়ার, বাজরা, রাগি প্রভৃতি কয়েকটি ক্ষুদ্র
দানাশস্যকে একত্রে মিলেট (Millet) বলে।
জোয়ার
জোয়ার গাছ, Photo: wikimedia.org |
ইংরেজি নামঃ Broom corn, great millet, durra, jowari / jowar, milo
বৈজ্ঞানিক নামঃ Sorghum bicolor
আঞ্চলিক নামঃ দিধান, জওয়ার, কাশাজোনার, কুরবি
জোয়ার ঘাস পরিবারের
(Gramene) একটি দানাদার ফসল। এটি শুধু পাখির খাদ্য নয়, গবাদি পশু এবং মানুষের জন্য
ও খুবই পুষ্টিকর খাবার। জোয়ার সারা বিশ্বে গ্রীষ্মমন্ডলীয় দেশে পাওয়া যায়। যদিও
আগে জোয়ার খুব বেশি খাওয়া হত না তবে এর গুণাবলী দেখে মানুষের মধ্যে জোয়ার প্রচলিত
হতে শুরু করে। এটি প্রথম দক্ষিণ আফ্রিকাতে চাষ হয়েছিল। এখন সব দেশে এই শস্য কৃষিকাজ
শুরু হয়েছে।
জোয়ার খরা প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন
এবং তুলনামূলকভাবে বেশ কম খরচে এর চাষ করা যায়। চাল, গম, ভুট্টার মতোই জোয়ার পুষ্টি
সমৃদ্ধ। খরা সহিষ্ণু হওয়ায় ফসলটি বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলসহ দেশের চরাঞ্চল ও
অন্যান্য উঁচু ও মাঝারি জমিতে আবাদ বৃদ্ধির ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে।
গমেতে যাদের অ্যালার্জি
রয়েছে তাদের জন্য জোয়ার রুটি উপকারী। জোয়ারে গমের চেয়ে বেশি প্রোটিন রয়েছে। এতে
রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম, পটাসিয়াম, ফসফরাস এবং আয়রন। এর বাইরেও রয়েছে
প্রচুর পরিমাণে ফাইবার।
জোয়ার পুষ্টিকর উপাদানে
সমৃদ্ধ। এতে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার, প্রোটিন, পটাসিয়াম, ফসফরাস, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন
বি কমপ্লেক্স এবং আয়রন রয়েছে যা স্বাস্থ্যের পক্ষে উপকারী।
জোয়ারের ব্যবহার : মানুষের
খাদ্য ছাড়াও জোয়ার পশু খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া জোয়ার হতে ইথানল, অ্যালকোহল,
স্টার্চ, আঠা, কাগজ, জৈব জ্বালানি তৈরি করা যায়। জোয়ার হতে চাল, আটা, বিস্কুট, কুকিস,
বেকড বিনস, পপড জোয়ার, মোয়া, নাড়ু, পায়েশ ইত্যাদিসহ বিভিন্ন টিনজাত খাদ্য প্রস্তুত
করা হয়।
বাজরা
বাজরা গাছ, Photo: Shanmugamp7 |
বৈজ্ঞানিক নামঃ Cenchrus americanus
বাজরা
ঘাসজাতীয় একটি দানাদার শস্য। এটি গ্লুটেনমুক্ত, ফাইবার শস্যসমৃদ্ধ, পুষ্টিকর এবং সহজে
হজমযোগ্য সুপারফুড হিসেবেও বিবেচিত। এটি আকার ও আকৃতির দিক থেকে বার্লির সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ,
তবে এতে ফাইবার আছে বার্লির চেয়েও বেশি।
প্রাগৈতিহাসিককাল
থেকে ভারত ও আফ্রিকায় এটির ব্যাপক চাষ হয়ে আসছে। বিনাযত্নে এমনকি চাষ ছাড়াই বাজরা চাষ
করা যায়। তবে ভালো ফলন পেতে হলে চাষ দেওয়ার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় সার ও সময়মতো সেচ দিতে
হয় | আমাদের দেশে বাজরা প্রধানত জুন-জুলাই মাসে চাষ করা হয়। বৃষ্টি না হলে বাজরা চাষে
সেচের প্রয়োজন হয়। তবে জলাবদ্ধ জমিতে এরা বাঁচতে পারে না। প্রাপ্তবয়স্ক গাছ কেটে রোদে
শুকিয়ে বাজরা সংগ্রহ করা হয়।
একসময়
দরিদ্র মানুষদের মধ্যে বাজরার রুটি, ছাতু খাওয়ার চল থাকলেও, বর্তমানে সব শ্রেণীর মানুষ
এই শস্য গ্রহণ করে থাকে।
বাজরা’র উপকারিতা
আটার
বিকল্প হিসেবে ব্যবহার: বাজরার রুটি আটার রুটির চেয়ে বেশি পুষ্টিকর ও উপকারী। বাজরায়
আয়রন ও এনার্জির পরিমাণ আটার তুলনায় বেশি। পাশাপাশি ক্ষতিকর কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণ
কম। এ ছাড়া এতে আছে প্রোটিন ও অ্যামিনো এসিড, যা আমাদের দেহগঠন ও সুস্থ রাখতে সাহায্য
করে।
ফলের
সমপরিমাণ পুষ্টিগুণ: ফল বা সবজির মধ্যে যে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট উপাদান থাকে, তার সমপরিমাণে
থাকে বাজরায়ও। তাই ফল খেলে যে উপকার হয়, তা আমরা সমানভাবে পেতে পারি বাজরা থেকেও।
বাচ্চাদের
জন্য উপকারী:
ছয় মাস বয়সের পর থেকে নিয়মিত বাজরা খেলে বাচ্চার হাড় শক্ত হয়, দৈহিক গঠন বৃদ্ধি পায়,
ওজন ঠিক থাকে এবং পরিপাকতন্ত্র সবল থাকে।
রক্তে
গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে: বাজরা, গম এবং ভুট্টার তুলনায় বাজরা থেকে পুষ্টি বেশি পরিমাণে
মেলে। এটি গ্লুটেন-মুক্ত এবং কম গ্লাইসেমিক সূচক। এতে প্রচুর পরিমাণে ডায়েটরি ফাইবার,
প্রোটিন, ভিটামিন এবং খনিজ থাকে, ফলে রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য
করে। তাই বাজরা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য অত্যন্ত স্বাস্থ্যকর খাদ্য।
হার্টের
জন্য ভালো:
বাজরা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ। এই অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এলডিএল কোলেস্টেরল, মোট কোলেস্টেরল
কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। রক্তনালী স্বাস্থ্যকর রাখে এবং রক্ত জমাট বাঁধা
দূর করে। যার ফলে হৃদরোগ এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি অনেকটাই কমে।
ক্যান্সারের
বিরুদ্ধে লড়াই করে: বাজরা বিভিন্ন টিস্যুতে ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধি আটকাতে পারে।
বাজরায় থাকা ফাইটোকেমিক্যালস সাধারণ কোষগুলির কোনও ক্ষতি না করেই কোলন, স্তন এবং লিভারে
antiproliferative প্রভাব এবং কম ক্যান্সার কোষের গঠনে সাহায্য করে।
হজমশক্তি
বাড়ায়:
বাজরাতে প্রচুর পরিমাণে ডায়েটরি ফাইবারের উপস্থিতি পাচনতন্ত্রের কার্যকারিতা উন্নত
করতে সাহায্য করে। এটি কোষ্ঠকাঠিন্য, পেট ফাঁপা, ফোলাভাব, ক্র্যাম্পিংয়ের বিরুদ্ধে
লড়াই করে। অন্ত্রের কার্যকারিতা উন্নত করে এবং লিভার, কিডনির মতো অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ
অঙ্গগুলি ভালো রাখে। এছাড়াও, বাজরা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে অত্যন্ত সহায়ক।
ওজন
কমাতে সাহায্য করে: অতিরিক্ত ওজন কমাতে সাহায্য করে বাজরা। তাই যাদের ওজন খুব বেশি
তারা দৈনন্দিন বাজরা দিয়ে তৈরি খাদ্য খেতে পারেন। ব্রেকফাস্টে বাজরার কিছু খেতে পারেন।
গমের পরিবর্তে বাজরার আটা দিয়ে তৈরি রুটি খেতে পারেন। প্রতিদিন ভাতের বদলে বাজরা দিয়ে
তৈরি খাদ্য খেতে পারলে তা চর্বি জমা কম করতে পারে, অন্ত্র ভালো রাখে। বাজরার আটা গ্লুটেন
ফ্রি এবং ফাইবার, ম্যাগনেশিয়াম ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় ভিটামিনে সমৃদ্ধ। আর এই সব পুষ্টিকর
উপাদান খিদে নিয়ন্ত্রণ করে এবং আমাদের শরীরে অতিরিক্ত ক্যালোরি জমা হতে দেয় না। ফলে
ওজন কম করা সম্ভব হয়।
রাগি
রাগি'র গাছ, Photo: wikimedia.org |
বৈজ্ঞানিক নামঃ Eleusine
coracana
আঞ্চলিক নামঃ মারুয়া
রাগি ঘাসের মতন দেখতে।
মিলেট জাতীয় ফসলের মধ্যে অন্যতম। এটি শুধু পাখির খাদ্য নয়, গবাদি পশু এবং মানুষের
জন্য ও খুবই পুষ্টিকর খাবার। অঙ্কুরিত রাগি দানা শিশুদের খাদ্য হিসাবে খুবই উপযোগী।
রাগি ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ
করতে সাহায্য করা হয়। চাল, ভুট্টা বা গমের তুলনায় রাগি শস্যের বীজের খোসায় প্রচুর
পরিমাণ পলিফেনল থাকে। যা রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণে রাখে।
শুকনো রাগি পিষে তৈরি
হয় আটা। রাগি আটা ওজন কমাতে সাহায্য করে। রাগিতে রয়েছে এক প্রকার অ্যামিনো অ্যাসিড,
যা ওজন কমাতে সাহায্য করে, এমনকী খিদেও নিয়ন্ত্রণ করে। রাগিতে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার
আছে, যা হজম ক্ষমতা ভাল করে। এছাড়াও এতে রয়েছে ভিটামিন সি। এটি কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ
করতে সাহায্য করে। ভাল ঘুম হয়। তাই রাতে রাগি খেলে ভাল হয়। এমনকী রাগিতে প্রচুর পরিমাণে
আয়রনও রয়েছে। রাগির আটা দিয়ে রুটি বানিয়ে আপনি খেতে পারেন। তাহলে সহজেই রাগি খেতে পারবেন
আপনি। এছাড়াও রাগির বিস্কুট বানিয়েও আপনি খেতে পারেন। শিশুদেরও রাগির আটা খাওয়াতে
পারেন।
চলমান...
তথ্য সূত্র
উইকিপিডিয়া
বিভিন্ন বই, প্রবন্ধ, পত্রিকা থেকে সংগ্রহ
Post a Comment