নিমের তেল

নিম ফলের বীজ থেকে নীম তেল তৈরি হয়। তাই নিম পাতা সিদ্ধ পানির থেকে এটা অনেক বেশি কার্যকর। তিক্ত স্বাদের এই উপাদানটি আপনার শরীরের অধিকাংশ সমস্যার স্থায়ী সমাধান দিয়ে থাকে। নীমের তেল, এটি একাধারে কার্যকরী জৈব কীটনাশক, মাকড়নাশক ও ছত্রাকনাশক, রুপচর্চার অন্যতম উপাদান, উৎকৃষ্ট মানের অ্যান্টি-সেপটিক সেই সাথে আছে হাজারো ওষধি গুণাগুণ এক কথায় এটি প্রকৃতির অলরাউন্ডার…

আজ আমরা ধারাবাহিক ভাবে নিম তেলের উপকারিতা এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে এর ব্যাবহারিক প্রয়োগ সম্পর্কে জানাব -


ত্বকের যত্নে নিম তেলঃ

নিমের তেল ত্বকের দাগ দূর করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেঃ

নিম তেল ফ্যাটি এসিডে সমৃদ্ধ যার ফলে এটি সহজে ত্বকের সাথে মিশে যায় এবং সংকোচন-প্রসারণ সহজতর হয়! নিয়মিত নিম তেল ব্যবহার করে ত্বকের বলিরেখা ও বার্ধক্যজনিত যাবতীয় দাগ দূর করা সম্ভব। এটি ত্বককে নমনীয় করে তোলে,  ত্বকের  লাল দাগসমূহ দূর করে, ব্রণের ক্ষত সারিয়ে তোলে। ছোট খাটো কাটা বা ক্ষত সারাতেও নিম তেলের জুড়ি নেই।

 

ত্বকের আর্দ্রতা ধরে রাখতে নিমের তেল খুবই উপকারীঃ

নিমের ভিটামিন ই ও ফ্যাটি এসিড ত্বকের আর্দ্রতা ধরে রাখতে গভীরভাবে কাজ করে। যাদের ত্বক শুষ্ক তারা নিয়মিত এই তেল লাগালে সমস্য়া অনেকটাই কমে যায়। প্রতিদিন নারকেল তেল বা অলিভ অয়েলের সঙ্গে নিম তেল মিশিয়ে ভালো করে সারা শরীরে মালিশ করলেই দেখা যাবে ত্বক সুন্দর হয়ে উঠছে।

 

নিমের তেল ব্যবহারে ব্রণের প্রকোপ কমায়ঃ

নিম তেলের অ্যাসপিরিন জাতীয় উপাদান ব্রণ হওয়ার জন্য দায়ী ব্যাকটেরিয়াগুলোকে ধ্বংস করে। নিম তেলে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকায় এটি ব্রণের সমস্যা কমাতে কাজ করে। ব্রণ কমাতে কয়েক ফোঁটা নিম তেলের সঙ্গে কয়েক ফোঁটা ল্যাভেন্ডার তেল মিশিয়ে ব্রণর উপর লাগাতে হবে।

 

নিমের তেল ব্যবহারে ত্বকে তারুণ্য ধরে রাখেঃ

নিমের তেলে আছে এন্টি অক্সিডেন্ট যা ত্বকের জন্য খুবই উপকারি। এটি ত্বকে বার্ধক্যের ছাপ সহজে পড়তে দেয় না। সময়ের সাথে সাথে কেউ যদি ত্বকের বয়স বাড়াতে না চায়, তাহলে নিয়মিত নিম তেল দিয়ে ত্বকের মাসাজ করতে হবে ! ফেসপ্যাকের সঙ্গে নিমের তেল মিশিয়েও লাগানো যায়!  এভাবে ব্যবহারে ত্বক সজীব হয়ে উঠে, বলিরেখা কমে, সাথে সাথে স্কিন টানটান হয়। ফলে ত্বকের বয়স কম লাগে।

 

অ্যাকজিমা প্রতিরোধ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেঃ

নিম তেল ত্বকের আর্দ্রতা বজায় রেখে অ্যাকজিমা প্রতিকার ও প্রতিরোধ করে। শরীরের যে জায়গায় একজিমা হয়েছে, সেখানে নিম তেল লাগালে যন্ত্রণা কমে।

* বংশগত কারণে কারও অ্যাকজিমা হলে নিমের তেল তা পুরোপুরি সারিয়ে তুলতে সক্ষম নাও হতে পারে।

** ভুলেও সরাসরি ত্বকের উপর নিম তেল ব্য়বহার করা যাবে না। সামান্য গরম পানিতে  কয়েক ড্রপ নিম তেল মিশিয়ে তা দিয়ে রোজ গোছল করলে রোগ কমতে শুরু করবে ।

 

ত্বক ফর্সা করে ও হাইপারপিগমেন্টেশন দূর করেঃ

নিমের তেলের ব্যবহার ত্বকে অতিরিক্ত মেলানিন তৈরিতে বাধা দেয়, আর মেলানিন কম থাকা মানে ত্বকে ফর্সাভাব বৃদ্ধি পাওয়া ! নিমের ফ্যাটি এসিড ত্বকে কোলাজেনের উৎপাদন বাড়ায় যার প্রভাবে স্কিন টোনের দ্রুত উন্নতি ঘটে ।

 

ত্বকে মেলানিনের পরিমান বাড়লেই লক্ষণ বাড়ে হাইপারপিগমেন্টেশনের! নিয়মিত যদি সারা শরীরে নারকেল তেলের সঙ্গে নিম তেল মিশিয়ে লাগানো যায় তাহলে মেলানিনের মাত্রা কমে। আর মেলানিন কমলে স্বাভাবিক ভাবেই কমতে শরু করে হাইপারপিগমেন্টটেশনও।

 

নিমের তেল কালচে আচিল দূর করেঃ

২-৩ ফোঁটা নিমের তেল পানিতে মিশিয়ে কালো আঁচিলে নিয়মিতভাবে লাগালে তা চিরতরে দূর হয়ে যায়

ত্বকের উন্মুক্ত ছিদ্র নিমের তেল দিয়ে বন্ধ করা সম্ভবঃ

নিমের এন্টিব্যকটেরিয়াল এবং অ্যান্টি ইনফ্লেমেটরি প্রপার্টিজ উন্মুক্ত ছিদ্র বন্ধ করতে দারুন কাজে আসে। নারকেল তেলের সঙ্গে নিম তেল মিশিয়ে মুখে লাগালেই  সমস্য়া কমতে শুরু করবে।

 

ত্বকে মশার আক্রমণ প্রতিরোধ করেঃ

বাড়িতে মশার উৎপাত বাড়লেই আমরা বাজার চলতি নানা ক্রিম লাগানো শুরু করি। কারও কি জানা আছে এই ধরনের সমস্যায় নিম তেল দারুন কাজে আসে। কীভাবে ব্য়বহার করতে হবে? খুব সহজ! ১০-১৫ ফোটা নিম তেল, হাফ কাপ নারকেল তেলের সঙ্গে মিশিয়ে গায়ে লাগান। তাহলেই দেখবেন মশারা আর ধারে কাছে ঘেঁষতে পারছে না।

 

অ্যাথলিট'স ফুট নিরাময়ে সাহায্য করেঃ

অস্বাস্থ্যকর অবস্থার জন্যই অ্যাথলিট'স ফুটের মত ছত্রাকজনিত সমস্যা হয়। অ্যাথলিট'স ফুট খুবই ব্যথাযুক্ত সমস্যা, কারণ এতে পায়ে প্রদাহের সৃষ্টি হয়। এই সমস্যাটির সমাধানের জন্য নিমের তেল ব্যবহার করুন। নিমের তেলের সাথে নারিকেলের তেল মিশিয়ে আক্রান্ত স্থানে ব্যবহার করুন।

 

চুলের যত্নে নিম তেলঃ

নিমের তেল চুল পড়া ও চুল ভাঙা রোধ করেঃ

প্রতিদিন কিছুটা পরিমাণ নিমের তেল নিয়ে মাথার ত্বক ও চুলে হালকা করে ঘষে ঘষে লাগিয়ে কিছুক্ষণের জন্য রেখে দিতে হবে এবং এরপর পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে। এতে চুল পড়া, চুল ভাঙা বন্ধ হবে এবং চুলের গোড়াও শক্তিশালী হয়ে উঠবে।

 

স্কাল্পের সংক্রমন জাতীয় সমস্যা ও খুশকি দূর করেঃ

ফাঙ্গাল ইনফেকশন হলে সাধারণত ত্বকে খুশকির সমস্য়া হয়ে থাকে। মাথার চুলে ও ত্বকে নিয়মিত নিম তেল ব্যবহারে খুশকি থেকে দূরে থাকা সম্ভব। এছাড়া মাথার স্কাল্পের যেকোনো ধরনের সংক্রমণ/ চুলকুনির সমস্যা কমাতেও নিম তেলের জুরি মেলা ভার। চুলে শ্যাম্পু করার সময় তাতে কয়েক ড্রপ নিম তেল মিশিয়ে নিয়ে মাথায় মেখে ২-৩ মিনিট অপেক্ষা করে ধুয়ে ফেলতে হবে , তাহলেই সমস্য়া কমতে শুরু করবে । এভাবে ব্যবহারে উসকোখুসকো ও প্রাণহীন চুলও তার উজ্জ্বল্য ফিরে পেতে পারে।

 

উকুন প্রতিহতঃ

নিয়মিত নিম তেল ব্যবহারে উকুন তাড়ানো সম্ভব। যাদের মাথার তালুতে ব্রণের সমস্যা আছে তারাও এই তেল মাথায় দিতে পারে।

 

শুষ্ক চুলের সমাধানঃ

নিম তেলে রয়েছে উচ্চ মাত্রায় ফ্যাটি অ্যাসিড। যেটা সুন্দর চুলের জন্য খুবই দরকারি একটি উপাদান। এটি চুলকে সুন্দর ভাবে কান্ডিশনিং করে। এবং চুলকে নরম রাখে এবং একটা সুন্দর ফুরফুরে লুক দেয়। চুলকে খুব ভালো ভাবে কান্ডিশনিং করার জন্য নিমতেল ভালো ভাবে স্ক্যাল্পে হালকা হাতে ম্যাসাজ করুন। এবং তারপর তোয়ালে দিয়ে মাথা ঢেকে রাখুন ১৫ থেকে ২০ মিনিট। তারপর ধুয়ে ফেলুন। চুল যথেষ্ট চকচকে ও হেলদি হবে।

 

নখের যত্নে নিম তেলঃ

নখ ভেঙ্গে যাওয়া, বাঁকা হয়ে যাওয়া রোধে নীম অয়েল বিশেষ উপকারি। নখের কোণের ফাঙ্গাস প্রতিরোধেও নীম অয়েল কাজ করে।


নিমের তেল ওষুধ ও জন্মনিরোধক হিসেবে কাজ করেঃ

নিম তেল একটি উৎকৃষ্ট মানের এন্টিসেপটিক! ডায়াবেটিস, আর্থ্রাইটিস ও উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসার জন্য যেসব ঔষধ গ্রহণ করা হয় সেগুলোতে নিমের তেল থাকে।

নিম তেল একটি উত্তম প্রাকৃতিক জন্ম নিরোধকও । নিম তেল একটি শক্তিশালী শুক্রাণুনাশক হিসেবে কাজ করে। ভারতীয় বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন যে, নিম তেল মহিলাদের জন্য নতুন ধরনের কার্যকরী গর্ভনিরোধক হতে পারে। এটি ৩০ সেকেন্ডের মধ্যেই শুক্রানু মেরে ফেলতে সক্ষম।


দাঁতের জন্য নিম তেলঃ

নিম তেল ক্যাভিটি সৃষ্টিকারী জীবাণু ধ্বংস করে! পেস্টে নিমের তেল ব্যবহার এখন অনেক দেশে সমাদৃত এবং বিশ্বব্যাপী পরিব্যাপ্ত! নিয়মিত ব্যবহারে দাত ও মাড়ি মজবুত হয়!


নিম তেলের অন্যান্য ব্যবহারিক প্রয়োগঃ

নিম অয়েল একটি উৎকৃষ্ট মানের অ্যান্টি-সেপটিক। ডায়াবেটিস, আর্থ্রাইটিস ও উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসার জন্য যেসব ঔষধ গ্রহণ করা হয় সেগুলোতে নিম অয়েল থাকে।

বাড়িতে পিঁপড়া, তেলাপোকা এবং অন্যান্য পোকামাকড়ের হাত থেকে রেহাই পেতে নিম অয়েল ব্যবহার করা যায়। বাড়িতে মশার উপদ্রব থেকে বাঁচতে পানির সাথে নিম অয়েল মিশিয়ে স্প্রে করা যেতে পারে। ঘরের মেঝে জীবাণুমুক্ত রাখতে সাবান পানিতে নিম অয়েল মিশিয়ে মুছে নিন। ছোট খাটো কাটা বা ক্ষত সারাতে নিম অয়েলের জুড়ি নেই।

 

সংরক্ষনঃ

এই তেল ঠান্ডা ও অন্ধকার জায়গায় সংরক্ষণ করে রাখতে হয় !

 

সতর্কতাঃ

নিমের তেল বা অন্যান্য নিমের পণ্য যেমন নিমের পাতা বা নিমের চা গর্ভবতী অথবা গর্ভধারণে আগ্রহী মহিলা এবং শিশুদের খাওয়া উচিৎ নয়! নিমের তেলের অতিরিক্ত সেবন লিভার নষ্টে সাহায্য করতে পারে বলে কিছু লক্ষণ পাওয়া গেছে।

* ত্বকে নিম তেল ব্যবহারের পূর্বে এক ফোটা তেল হাতের তালুর  উপরিভাগে লাগিয়ে পরীক্ষা করে নেয়া ভালো! ২৪ ঘন্টার মধ্যে যদি কোনো এলার্জি (যেমন লাল হয়ে যাওয়া বা ফোলাভাব) এর লক্ষণ না দেখা যায় তবে নিশ্চিন্তে এটা শরীরের যে কোনো জায়গায় ব্যবহার করা যেতে পারে



তথ্য সূত্র --------------------------

বোল্ডস্কাই

organiconline.com.bd

বিভিন্ন বই, প্রবন্ধ থেকে তথ্য সংগ্রহ

Image Source: indianearthynaturals.com

Post a Comment

Previous Post Next Post