অরিগ্যানো, Photo : trees.com

অরিগ্যানো, ওরেগানো, অরিগানো বাংলায় বিভিন্ন বানানে লিখলেও অরিগ্যানো বানানটাই সঠিক মনে করছি। ইংরেজিতে Oregano, বৈজ্ঞানিক নাম Origanum vulgare । অরিগ্যানোর আরেক নাম মেক্সিকান মিন্ট।

পুদিনা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত একটি সপুষ্পক উদ্ভিদ। এটি পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিম ইউরেশিয়ার নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে এবং ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে দেখতে পাওয়া যায়।

অরিগ্যানো কেবল খাবারের স্বাদ বাড়ানোর মশলাই নয় এর অনেক গুণ আছে। অরিগ্যানো একটি ভেষজ ঔষধি। এটি দ্বারা যেমন স্বাস্থ্যকর চা বানানো যায় তেমনি এটি রূপচর্চার জন্যও ব্যাপক কার্যকর একটি উপাদান। এই সব গুলো বিষয় নিয়ে সাজানো হয়েছে এই আর্টিকেল।   

বর্তমানে ভারতীয় উপমহাদেশে এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন নামীদামী রেস্টুরেন্টে রান্নায় এবং পিজ্জায় বহুল প্রচলিত একটি মসলা। সাধারণত পাস্তা, পিজ্জা ,সস এবং রোস্টেড ভেজিটেবিল এ ব্যবহৃত হয়। অরিগ্যানো পাতা রান্নায় স্বাদ ও গন্ধ যোগ করতে ব্যবহার করা হয় । টাটকা পাতার চেয়ে শুকনো পাতা ব্যবহারে স্বাদ ও গন্ধ বেশি পাওয়া যায়।  

অরিগ্যানো আধুনিক ইতালীয় রন্ধনশৈলীতে ব্যবহৃত প্রধান একটি ভেষজ মসলা। সেখানে এটির স্থানীয় নাম ওরেগানো। মূলত দক্ষিণ ইতালির মসলাযুক্ত খাবারের সাথে এটি বেশি ব্যবহার করা হয়। উত্তর ইতালীয় রান্নাতে সাধারণ অরিগ্যানো বেশি পছন্দের মসলা।

২য় বিশ্বযুদ্ধ শেষে মার্কিন সৈন্যরা ইতালি থেকে ফেরত আসার সময় পিজ্জার মসলা হিসেবে ওরেগানো দেশে ফেরত নিয়ে আসে এবং তখন থেকে মসলাটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও জনপ্রিয়তা লাভ করে।

ইতালি ছাড়াও সমগ্র ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলেই, বিশেষত তুরস্ক ও গ্রিসে অরিগ্যানো ব্যাপকভাবে প্রচলিত। এছাড়া ফিলিপাইন ও লাতিন আমেরিকাতে বিশেষ করে আর্জেন্টিনীয় রন্ধনশৈলীতে এর ব্যাপক ব্যবহার আছে।


অরিগ্যানোতে রয়েছে ম্যাঙ্গানিজ, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন সি, ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড। অরিগ্যানো পরিপাকতন্ত্র ভালো রাখে। এখন জানব অরিগ্যানোর কিছু ভেষজ গুণঃ

সর্দি : ২/৩টি মাঝারি সাইজের পাতা পানিতে ফুটালে যে বাষ্প উঠবে, সেটি নাকে নিলে সর্দি বের হয়ে যায়। এটি সাইনুসাইটিসেও বেশ উপকারী।

কাশি : সর্দি কাশির প্রবণতা যেসব শিশুদের বেশী, তাদের ৭/৮ ফোটা এর পাতার রস একটু মধু মিশিয়ে খাওয়ালে ভালো ফল পাওয়া যায়।

দাঁতব্যথা : অরিগ্যানো পাতা থেতো করে দাঁতের গোড়ায় লাগালে ব্যথা কমে যাবে।

পেটফাঁপা : অরিগ্যানোর ২/৩ টি পাতা পানিতে ফুটিয়ে ঠান্ডা করে (আধ কাপ) খেতে হবে। এতে করে পেট ফাঁপাটা চলে যাবে।

মাথাব্যথা : ছোট ২ টি পাতা চায়ে দিয়ে ফ‌ুটিয়ে খেলে মাথা দ্রুত আরোগ্য হয়। এটি মানসিক অবসাদেও ভালো কাজ করে।

ব্রণ : অরিগ্যানো পাতা থেতো করে মুলতানী মাটি মিশিয়ে ব্রণে লাগালে ওটা সেরে যায়।

খুশকী : অরিগ্যানো পাতা পানিতে জাল দিয়ে ওটা দিয়ে মাথা ধ‌ুয়ে ফেললে খুশকী চলে যায়।


রূপচর্চায় অরিগ্যানোঃ

ত্বকের যত্ন : ত্বকে কোনওরকম সংক্রমণ এড়াতে বা কোনও সংক্রমণ হলে তার প্রভাব কমাতে অরিগ্যানো ব্যবহার করা যেতে পারে। এর অ্যান্টিব্যাক্টেরিয়াল বৈশিষ্ট্য সংক্রমণ ছড়ায় এমন ব্যাক্টেরিয়া দূর করে। এর অ্যান্টি-ইনফ্ল্যেমেটরি এবং ইমিউনোমডুলেটরি (Immunomodulatory) বৈশিষ্ট্য ত্বকের প্রদাহ কম করতে পারে। এতে ক্যান্সার বিরোধী বৈশিষ্ট্যও রয়েছে, যা স্কিন ক্যান্সারের ঝুঁকি কম করতে পারে।

ব্যবহারের নিয়মঃ

একটি বাটিতে ২ ফোটা অরিগ্যানো তেল (ঘরেই অরিগ্যানো তেল বানানোর নিয়ম নিচে আলোচনা করা হয়েছে) এর সাথে ২ চামচ নারকেল তেল বা জয়তুন তেল মিশিয়ে নিয়ে তুলোর সাহায্যে ত্বকের উপর লাগিয়ে নিন। এভাবে দিনে দু’বার ব্যবহার করতে পারেন।

গরম পানিতে অরিগ্যানো তেল ৪-৫ ফোটা দিয়ে, ১০ মিনিট পর্যন্ত ভাপ নিতে পারেন। ভাপ নেওয়ার সময় অবশ্যই সাবধানতা বজায় রাখুন।

 

চুলের সৌন্দর্য : যারা চুল পড়ার সমস্যায় ভুগছেন তারা অরিগ্যানো ব্যবহার করতে পারেন। গবেষণায় দেখা গেছে যে, অক্সিডেটিভ স্ট্রেস চুল ওঠার অন্যতম কারণ হতে পারে। যেমনটি আগে উল্লিখিত, অরিগ্যানো কার্যকরী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করতে পারে, তাই বলা যেতে পারে এর অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট বৈশিষ্ট্য অক্সিডেটিভ স্ট্রেস কম করতে এবং চুল পড়ার সমস্যা রোধ করতে সাহায্য করতে পারে।

ব্যবহারের নিয়মঃ একটি বাটিতে ৩-৪ চামচ নারকেল তেল বা জয়তুন তেল নিয়ে হালকা গরম করে নিন। গরম করার পর তাতে ২-৩ ফোটা অরিগ্যানো অয়েল মিশিয়ে নিন। এরপর ২০ মিনিট ধরে চুলে মিশ্রণটি ম্যাসাজ করুন। ম্যাসাজ করার পর ১০ মিনিট রেখে দিয়ে শ্যাম্পু করে ঠান্ডা পানি দিয়ে চুল ধুয়ে ফেলুন।


 

অরিগ্যানো তেল তৈরীঃ

গাছ হতে তাজা পাতা নিয়ে তা ব্লেন্ডার মেশিনে ব্লেন্ড করে তা কুকারে জাল দিতে হবে। শরীরে মাখা যে কোন তেল যতটা ঘন সে রকম না হওয়া পর্যন্ত জাল দিতে হবে। এভাবেই ধিরে ধিরে অরিগ্যানো তেল প্রস্তুত হবে। তেল পুরাপুরি প্রস্তুত হয়ে গেলে কাচের পাত্রে সংরক্ষণ করতে হবে যাতে সরাসরি বাতাস না লাগে।

 

অরিগ্যানো চাঃ

আপনি তাজা বা শুকনো পাতা থেকে অরিগানো চা তৈরি করতে পারেন। ৫ বা ১০ মিনিটের জন্য এক কাপ উষ্ণ পানির সাথে মধ্যে তাজা পাতা বা আধা চা চামচ শুকনো পাতা দিয়ে ভালো মতো সিদ্ধ করে নিন। হয়ে গেল অরিগ্যানো চা। তবে কাঁচা পাতার চেয়ে শুকনো পাতার ফ্লেভার অনেক গুণ বেশি।

অরিগ্যানো চা কিছুটা তিক্ত হতে পারে, কিন্তু চিনি বা মিষ্টি যোগ করে এই তিক্ততা প্রতিহত করতে পারেন। চাইলে লেবুও ব্যবহার করা যেতে পারে। এছাড়াও, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে কালোজিরা, দারুচিনি, লবঙ্গ বা মধু ও যোগ করতে পারেন।  

 

শেষ করার আগে অরিগ্যানো’র একটি সহজ এবং মজাদার রেসিপি শেয়ার করছি সেটা হচ্ছে -

অরিগ্যানো পাতার চপঃ

প্রথমে একটি বাটিতে বেসন নিয়ে তাতে একে একে পরিমাণ মতো লবণ, হলুদ, মরিচ গুঁড়া,জরদা রং, খাবার সোডা,ও ম্যাগি মসলা দিয়ে একটি বাটার তৈরি করে তাতে অরিগেনো পাতা ডুবিয়ে গরম ডুবো তেলে ভেজে নিন। তারপর গরম গরম পরিবেশন করুন মজাদার অরিগেনো পাতার চপ।

 

অরিগ্যানোর ব্যবহারের পাশ্বপ্রতিক্রিয়াঃ

অরিগ্যানো পরিমিত মাত্রায় ব্যবহার সম্পূর্ণ নিরাপদ। যদিও কিছুক্ষেত্রে এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়, সেগুলি হলঃ

গর্ভাবস্থা এবং স্তন্যপান : অরিগ্যানো গর্ভবতী এবং যারা স্তন্যপান করাচ্ছেন তাদের জন্য ক্ষতিকারক হতে পারে। গর্ভাবস্থায় অরিগ্যানো অতিরিক্ত মাত্রায় গ্রহণ করলে গর্ভপাত ঘটতে পারে বলে অনেকের বিশ্বাস।

 

রক্তস্রাবের সমস্যা : রক্তক্ষরণ রক্তপাতের ব্যাধি হিসেবেও পরিচিত। আঘারের পরে রক্তপাত সহজে থামে না। এই সমস্যায় শরীরে প্লেটলেটগুলির পরিমাণ কমে যায়, যার কারণে ত্বকে রক্ত জমাট বাঁধে না এবং রক্তপাত বন্ধ হয় না। এটি ঋতুস্রাব, আঘাত এবং শল্য চিকিৎসা ইত্যাদিতে স্বাবাবিকের চেয়ে বেশি রক্তক্ষরণ ঘটে । অরিগ্যেনো রক্তক্ষরণে ভুগতে থাকা মানুষের সমস্যা বাড়িয়ে তুলতে পারে।

 

অ্যালার্জি : যাদের তুলসী, পুদিনা, ল্যাভেন্ডার জাতীয় ভেষজের প্রতি অ্যালার্জি আছে তাদের অরিগ্যানো থেকেও অ্যালার্জি হতে পারে। কারণ অরিগ্যানোও একই পরিবারের উদ্ভিদ।

 

ব্লাড সুগার লেবেল : অরিগ্যানো ব্লাড সুগার লেবেুন কম করতে পারে। এজন্য অতিরিক্ত মাত্রায় এর ব্যবহার সমস্যা ডেকে আনতে পারে।

 

ত্বকে জ্বালা : অরিগ্যানো তেল সরাসরি ত্বকের উপর লাগালে জ্বালা যন্ত্রণা হতে পারে। সেই জন্য সবসময় অন্য কোনও তেল যেমন নারকেল বা জয়তুন তেল মিশিয়ে ব্যবহার করা উচিত।

 


এই আর্টিকেলে অরিগ্যানো সম্পর্কিত বিস্তারিত ধারণা দেওয়ার চেস্টা করা হয়েছে। আশা করি, এর ব্যবহার গুলো সবার জন্য উপকারে আসবে এবং যাদের এই গাছটির ব্যাপারে ধারণা ছিল না তারাও এটির গুণাগুণ উপভোগ করতে পারবেন। অবশ্যই পরিমিত মাত্রায় এবং এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কথা মাথায় রেখে ব্যবহার করতে হবে। তবে কোনও শারীরিক সমস্যা থাকলে অরিগ্যানো ব্যবহার করতে পারবেন কি না সে বিষয়ে অবশ্যই আপনার ডাক্তারের সঙ্গে আলোচনা করুন। 

 

 

সূত্র:

USDA

stylecraze.com  

উইকিপিডিয়া 

বিভিন্ন বই, প্রবন্ধ, পত্রিকা থেকে সংগ্রহ 

Post a Comment

Previous Post Next Post